পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (পিসিওএস) প্রজননক্ষম মহিলাদের একটি হরমোনজনিত রোগ। ১৪-৪৫ বছর বয়সি মহিলাদের ৬-১৪ শতাংশ (গড়ে ১০ শতাংশ) এ সমস্যায় ভুগেন; পিসিওএস এ বয়সি মেয়েদের অন্যতম হরমোনজনিত রোগ। পিসিওএস-এ আক্রান্ত বেশিরভাগ মহিলাদের মধ্যে উচ্চমাপের অ্যান্ড্রোজেন অথবা পুরুষ হরমোনগুলোর উপস্থিতি থাকে। মেয়েদের দেহে অ্যান্ড্রোজেন হরমোন স্বাভাবিকের বেড়ে গেলে এর প্রভাবে ডিম্বাশয়ের আশপাশে ছোট ছোট সিস্ট তৈরি হয়। ফলে ডিম্বাশয় থেকে যে ডিম্বাণু বড় হয়ে বের হওয়ার পথে বাঁধা সৃষ্টি হয় এবং এভাবে একসময় ডিম্বাণু বের হওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে নিয়মিত ঋতুচক্র বাধাগ্রস্ত হয়। পিসিওএস প্রধানত কিশোরী ও নারীদের প্রজননক্ষম সময়ে হয়ে থাকে।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম।
* উপসর্গ
অনিয়মিত মাসিক, অতিরিক্ত রক্তস্রাব, মুখে ও শরীরে অত্যধিক লোম (পুরুষালি), মুখে ও শরীরের অন্যান্য অংশে ব্রণ। আরও কিছু শারীরিক সমস্যা এর সঙ্গে থাকতে পারে- তলপেটে ব্যথা, মকমলের মতো কালো ত্বক (ঘাড়, বগল ইত্যাদি জায়গায়), বন্ধ্যত্ব।
এ রোগীদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এদের অনেকেই দৈহিক স্থূলতায় আক্রান্ত হয়, নাকডাকা ও ঘুমের সময় হঠাৎ করে শ্বাস বন্ধ হওয়া, হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া, মানসিক ভারসাম্যহীনতা ও জরায়ু ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেতে পারে।
লক্ষণ কী কী-
* অনিয়মিত মাসিক : বেশিরভাগ মেয়েদের ৪০ বা ৪৫ বা ৫০ দিন বা কারও কারও ক্ষেত্রে আরও বেশি দিন পর পর ঋতুস্রাব হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অল্প মাত্রায় ঋতুস্রাব হতে পারে, কারও কারও ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ঋতুস্রাব হয়। মাসের পর মাস ঋতুস্রাব বন্ধ থাকাও অস্বাভাবিক নয়। বয়ঃসন্ধিকালের শুরুতেই এ সমস্যা শুরু হতে পারে, প্রজননক্ষম সময়ে অন্য যে কোনো সময়েও এ সমস্যা শুরু হতে পারে।
* বন্ধ্যাত্ব : যতজন নারী সন্তান নিতে ব্যর্থ হচ্ছে, তাদের একটা বড় অংশই পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমের কারণে হয়। আর এ বন্ধ্যত্বের কারণ হলো-ঋতুচক্রের অনেকগুলোতেই ডিম্বাণুর অনুপস্থিতি। পুরুষালি হরমোনের অধিক মাত্রায় উপস্থিতিও এর বহিঃপ্রকাশ। এর ফলস্বরূপ নারী দেহে পুরুষদের মতো লোম দেখা দিতে পারে (হার্সোটিজম), মুখে বা শরীরের অন্যান্য জায়গায় ব্রণ হওয়া, পুরুষালি টাক পড়ে ইত্যাদি। প্রতি চারজনের মধ্যে পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমের নারীর তিনজনের দেহে এ লক্ষণগুলো থাকে।
* মেটাবলিক সিন্ড্রোম : এতে পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমে আক্রান্ত নারীর দেহে ইনস্যুলিন রেজিস্ট্রেন্সের লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে থাকে-ক্রমশ দৈহিক ওজন বৃদ্ধি হওয়া, ক্ষুধা বৃদ্ধি পাওয়া, দুর্বলতা, স্মৃতিশক্তি দুর্বলতা, ঘাড়ের পিছনে বা বগলে নরম কালো ত্বকের উপস্থিতি, রক্তের গ্লুকোজ কিছুটা বেড়ে যাওয়া, কলস্টেরল অস্বাভাবিক থাকা ইত্যাদি।
* রোগ শনাক্তকরণ
পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম শনাক্ত করতে সচরাচর নিুলিখিত ক্রাইটেরিয়ার যে কোনো দুটির উপস্থিতি আবশ্যক-
নারীদেহে অতিরিক্ত এন্ড্রোজেন হরমোন উপস্থিতির প্রমাণ, অনিয়মিত ঋতুস্রাব, ডিম্বাশয়ে সিস্ট।
* পরীক্ষা-নিরীক্ষা
সিরাম টেস্টোস্টেরন, পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম এবং ওজিটিটি।
* চিকিৎসা
জীবন-যাত্রা ব্যবস্থাপনা : চিকিৎসার শুরুতেই খাদ্য ব্যবস্থাপনার দিকে গুরুত্বপূর্ণভাবে লক্ষ রাখতে হবে। খাদ্য ব্যবস্থাপনা রোগীর দৈহিক ওজন কাক্সিক্ষত মাত্রায় পৌঁছাতে সাহায্য করবে, বিপাকীয় প্রক্রিয়ার উন্নতি ঘটাবে যাতে করে ইনস্যুলিন রেজিস্ট্রেন্স কমে যাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। আদর্শ জীবন-যাপন ব্যবস্থাপনা রোগীর হৃদরোগ ও ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কমাবে।
পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমের খাদ্য তালিকায় শর্করার আধিক্য কম থাকবে, শাকসবজি (আলু বাদে), রঙিন ফলমূল ও আমিষজাতীয় খাদ্য প্রাধান্য পাবে। দৈহিক ওজন বিবেচনায় রেখে শারীরিক শ্রমের ব্যবস্থা করতে হবে। এ সমস্যায় আক্রান্ত নারীদের অধিকাংশই তাদের শারীরিক লক্ষণগুলোকে খুব দ্রুত বুঝতে পারেন না। কেউ কেউ লক্ষণগুলো বুঝতে পারলেও সংকোচ বোধের কারণে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে দেরি করেন। যেহেতু রোগটির ব্যাপকতা ও সুদূরপ্রসারী স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে, তাই প্রজননক্ষম বয়সের সব নারীকে তার এ সমস্যা আছে কিনা জানার জন্য হরমোন বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।